ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত: ২৫/০৭/২০২৫ ১০:৩৪ এএম

ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে দেশের প্রধান পর্যটন শহর কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন চালু হয়েছে দেড় বছর আগে। প্রকল্পটি নেওয়ার সপক্ষে বলা হয়েছিল, এই রেলপথ চালু হলে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলবর্তী কক্সবাজার জেলার মৎস্য, বনজ ও কৃষিজ পণ্য কম খরচে সারা দেশে সরবরাহ করা যাবে। তাতে রেলওয়ের বছরে ৫০ কোটি টাকা আয় হবে।

নতুন এই রেলপথে ট্রেন চলাচল শুরু হয় ২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর। বর্তমানে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সঙ্গে দুটি করে চারটি যাত্রীবাহী ট্রেন কক্সবাজার আসা-যাওয়া করে। অর্থাৎ পণ্যবাহী ট্রেন চালু হয়নি। এমনকি যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতেও পণ্যবাহী কোনো লাগেজ ভ্যান যুক্ত করা হয়নি; যে কারণে বিপুল ব্যয়ে নির্মিত এই রেলপথ নির্মাণের সুফল মিলছে না।

ব্যবসায়ীরা জানান, তাঁরা শুরু থেকেই কক্সবাজার থেকে পণ্যবাহী ট্রেন চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন। সেটি হলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কে পণ্য বহনকারী গাড়ির চাপ কমবে। বর্তমানে এই সরু মহাসড়কে দিনে গড়ে পাঁচ হাজারের মতো গাড়ি চলাচল করে। এতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। পণ্যের বড় অংশ যদি ট্রেনে পরিবহন করা হয়, তাহলে সড়কে গাড়ির চাপ কমে দুর্ঘটনার হার কমতে পারে।

এদিকে পণ্য পরিবহন ট্রেন বা কোচ সংযুক্ত করা নিয়ে রেলওয়ের প্রকৌশল ও বাণিজ্যিক বিভাগের দুই ধরনের মত রয়েছে। রেলওয়ের বাণিজ্যিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, কক্সবাজারের স্থানীয় কিংবা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের কারও কাছ থেকেই তাঁরা এখনো এই পথে ট্রেনে পণ্য পরিবহনের কোনো চাহিদা পাননি। তবে পণ্যবাহী ট্রেন চালুর জন্য পর্যাপ্ত ইঞ্জিনও নেই। আবার রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের মতে, চাহিদা না থাকার বিষয়টি সঠিক নয়। উদ্যোগ নেওয়া হলে ঠিকই সাড়া পাওয়া যাবে।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান বাণিজ্যিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজারে পণ্য পরিবহনের বিষয়ে আপাতত কোনো পরিকল্পনা নেই। কেননা বর্তমানে ইঞ্জিন-সংকট প্রকট; যে কারণে নিয়মিত পণ্যবাহী ট্রেন চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আর কক্সবাজারের কারও কাছ থেকে কখনো কোনো চাহিদা বা আগ্রহ পাওয়া যায়নি। তবে এ নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। তাঁরা যদি চাহিদা দেন, তাহলে বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।

রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্পটির পরিচালক মোহাম্মদ সবুক্তগীনও প্রথম আলোকে বলেন, কক্সবাজার থেকে পণ্য পরিবহনে চাহিদা নেই, বিষয়টি এ রকম নয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পথে আন্তনগর ট্রেনে দুটি লাগেজ ভ্যান যুক্ত করার পরিকল্পনা আছে। এ নিয়ে বাণিজ্যিক বিভাগের সঙ্গে আলাপ করা হবে। রেলওয়ের নিয়মিত মাসিক সভাতেও বিষয়টি তোলা হবে। রেলওয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলে সাড়া পাওয়া যেতে পারে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

উদ্দেশ্য আর বাস্তবতায় বিরাট ফারাক
চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ নির্মাণে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার পথে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে রেলওয়ের বছরে ৪৪২ কোটি টাকা আয় হবে। সারা দেশ থেকে কক্সবাজারে যত পর্যটক আসেন, তার অন্তত ৫০ শতাংশ পাবে রেল। প্রথম বছরেই যাত্রী পরিবহনে ৩৯২ কোটি টাকা ও পণ্য পরিবহনে ৫০ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব হবে। কিন্তু বক্তব্য আর বাস্তবে দুই স্তর ফারাক দেখা গেছে। প্রথম এক বছরে যাত্রীবাহী ট্রেন চালিয়ে আয় হয়েছে মাত্র ৮০ কোটি টাকা, যা লক্ষ্যমাত্রার পাঁচ ভাগের এক ভাগ।

লবণ পরিবহনে সড়কে ঝুঁকি
পাহাড়, সমুদ্র ও সীমান্ত থাকায় (মিয়ানমারের সঙ্গে) কক্সবাজারের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বেশি। বিশেষ করে সমুদ্রের কারণে এখানে মৎস্য ও লবণশিল্পের বিকাশ ঘটেছে। দেশে লবণের মোট চাহিদার সিংহভাগই যায় কক্সবাজার অঞ্চল থেকে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মতে, চলতি বছরে দেশে লবণের বার্ষিক চাহিদা হলো ২৬ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে কক্সবাজারে অঞ্চলেই উৎপাদন হয়েছে সাড়ে ২২ লাখ মেট্রিক টন।

কক্সবাজার থেকে ট্রাকে করে লবণ সারা দেশে নেওয়া হয়। এ কারণে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেননা লবণবাহী পরিবহন থেকে পানি পড়ে সড়ক পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। যেমন এ বছরের ঈদুল ফিতরের ছুটিতে ৪৮ ঘণ্টায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের লোহাগাড়ার জাঙ্গালিয়ায় তিনটি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে ১৬ জনের, আহত হয়েছেন ২০ জন। তখন পুলিশ ও সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও লবণপানির কারণে এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই কক্সবাজারে উৎপাদিত লবণ ট্রেনে সরবরাহ করা হলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি অনেকাংশে কমবে।

মৎস্য ও কৃষিপণ্য পরিবহনের সম্ভাবনা
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এই জেলায় বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ২ লাখ ৪৯ হাজার মেট্রিক টন। এর মধ্যে ইলিশ প্রায় ৩৬ হাজার মেট্রিক টন। এই জেলায় মাছের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ৬০ হাজার মেট্রিক টন। বাকি ১ লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন মাছ চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। এ ছাড়া বছরে কয়েক শ কোটি টাকার শুঁটকি উৎপাদিত হয়। এর বড় অংশই মাছের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়।

ব্যবসায়ীরা বলেন, আকারে বড় হওয়ায় সারা দেশে কদর রয়েছে কক্সবাজারের সুপারির। বিভিন্ন দেশেও রপ্তানি হয় এখানকার সুপারি। মৌসুমে সপ্তাহে গড়ে ২২৫ ট্রাক সুপারি দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলার উখিয়া, টেকনাফ, রামু, কক্সবাজার সদর, ঈদগাঁও, চকরিয়া, পেকুয়া উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় ৮ হাজার ৬৪৫ একর জমিতে সুপারিবাগান রয়েছে। সুপারি উৎপাদিত হয় ১২ হাজার ৯৬৭ মেট্রিক টনের মতো। প্রতি কেজি শুকনা সুপারির দাম ৩০০ টাকা ধরলে বছরে উৎপাদিত হয় ৩৯০ কোটি টাকার সুপারি।

শীতকালে কক্সবাজারে উৎপাদিত সবজি ট্রাকসহ বিভিন্ন গাড়িতে করে চট্টগ্রাম-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। ট্রেনে সবজি পরিবহনের ব্যবস্থা করা হলে এখানকার কৃষকেরা উপকৃত হবেন।

কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, প্রথম থেকেই তাঁরা কক্সবাজারে যাত্রীবাহী ট্রেনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রেন চালুর দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু এখনো তাঁদের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তিনি বলেন, যদি পণ্যবাহী ট্রেন কিংবা চালু থাকা যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে আলাদা কোচ বরাদ্দ দেওয়া হতো, তাহলে কক্সবাজার থেকে পণ্য যেমন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহজে পাঠানো যেত, তেমনি বাইরে থেকেও এখানে পণ্য আনা সহজ হতো। তাই রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যেন দ্রুত পণ্যবাহী ট্রেন বা চালু ট্রেনে কোচ যুক্ত করার উদ্যোগ নেয়। সুত্র: প্রথম আলো

পাঠকের মতামত

কক্সবাজার হোটেল মিশুকে জার্মান পর্যটককে লাইনের পানি দিয়ে মিনারেল পানির বিল

কক্সবাজারের হোটেল মিশুকে এক জার্মান পর্যটককে লাইনের পানি দিয়ে মিনারেল পানির বিল ধরিয়ে হয়রানি করার ...

‘ রাখাইনে আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের উপর ‘যুদ্ধাপরাধ’ করছে ‘ – ফোর্টিফাই রাইটস

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটস মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ) কর্তৃক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর ...

উখিয়া-টেকনাফ সড়কজুড়ে রোহিঙ্গাদের জন্য স্থানীয়দের দুর্ভোগ

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফ সড়কে প্রতিদিনের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠেছে অসহনীয় যানজট। প্রধান সড়কের কুতুপালং, মরাগাছতলা, বালুখালী, কোর্টবাজার ...